শুক্রবার,২৬,এপ্রিল,২০২৪
32 C
Dhaka
শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়লাল পতাকাই শোষণ মুক্তির দিশারী

লাল পতাকাই শোষণ মুক্তির দিশারী

মহামারিতে শ্রমজীবীদের নীরব উচ্চারণ

“নাম তার ছিল জন হেনরি, ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন”- কেবল কিংবদন্তী গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীরে কণ্ঠে নয়, আজো সারা দুয়িার মানুষ বুক চিতিয়ে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে জন হেনরি’কে। মার্কিন এই শ্রমিক নেতা হাতুড়ি’তে পাথর কেটে সুরঙ্গ তৈরি করে ইঞ্জিনের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। সেদিন তিনি মৃত্যুবরণ করলেও তার বিজয়ী হাসি বুঝিয়ে দিয়েছিল শ্রমিক’ই সেরা। এই করোনাকালেও মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন শ্রমজীবীরাই। প্রমাণ করেছেন লুটেরা পুঁজিপতি লুট করে, কিন্তু দুঃসময়েও স্থবির অর্থনীতি সচল রাখে শ্রমজীবীরাই। আপসোস! এতকিছুর পরেও উল্টো দিকে ঘুরছে শ্রমিকের ভাগ্যের চাকা। বঞ্চিত নানা অধিকার থেকে। দাবি আদায়ে নামতে হচ্ছে রাজপথে। ‘মহান মে দিবস’-সেই অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সংগঠিত হওয়ার প্রেরণা। ঐক্য ও সংহতিতে জেগে ওঠার দিন। ফি বছর, ১ মে শ্রমিকেরা উৎসবে মিলিত হন, শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকংম্পিত করেন রাজপথ। কিন্তু গত বছরের মতো এবারো কারখানার গেট থেকে রক্তপতাকায় উদ্বেলিত শ্লোগান মুখর শ্রমিক র‌্যালি বের হয় নি। কোনো শ্রমিক পা মেলাননি রাজপথের মিছিলে। করোনার কারণে এবারও ‘মে দিবস’ পালিত হলো ভিন্ন আঙ্গিকে। তবে এবার ‘মে দিবসে’- উৎসব আয়োজন না থাকলেও শ্রমজীবী মানুষের চোখে-মুখে ছিল অধিকার আদায়ের সংগ্রামী তেজ। নীরব উৎসবে এবার তারা হৃদয় দিয়ে বুঝেছে, ‘মে’ কোনো আনন্দ-উৎসবে কাটিয়ে দেওয়ার দিন নয়। ‘ মে ’ হাজারো শ্রমিকের পথচলা মিছিলের কথা, একই পতাকা তলে দাঁড়িয়ে আপোসহীন সংগ্রামের কথা। এবার তারা উলব্ধি করেছে ‘মে দিবস’ শোষণ মুক্তির অঙ্গীকার। শ্রমজীবী মানুষ এবার বলেছেন, “ পুঁজিবাদ শোষণের মেশিন, সেই মেশিনে তালা লাগাতে প্রয়োজন মুক্তির মূল পথ সমাজতন্ত্র।” অদৃশ্য শত্রু কোভিড-১৯ তার দানবীয় ছোবলে কেবল দুনিয়াটাকে মৃত্যুপুরি’ই বানায় নাই, একই সাথে অর্থনীতিকেও ল-ভ- করেছে। তবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, লুটেরা পুঁজিপতি ও তাদের মতবাদ পুঁজিবাদ মহামারিতে একেবারেই অচল। তারা মানুষকে মুক্তি পথ দেখাতে পারে না। থামাতে পারে না মৃত্যুর মিছিল। বরং নিজেদের পুঁজি ঠিক রাখতে এবং টাকার পাহাড় গড়তে শ্রমজীবী মানুষকে ওরা মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলতেও দ্বিধা করে না। করোনার ভয়াবহতা ঠেকাতে সবকিছু যখন বন্ধ, তখন খোলা ছিল শ্রমিকের কারখানা। সেখানে সরকার শ্রমিকের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার কথা বললেও মালিকরা তা মানছে না। তাই মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই শ্রমিক যাচ্ছেন কারখানায়। তারপরেও চলছে শ্রমিক ছাঁটাই, বেতন ছাঁটাই, বকেয়া বেতন না দেওয়ার তালবাহানা। কখনো আবার কারাখানাতেই তালা দেওয়া হচ্ছে। এই করোনার মধ্যেও দেশের ২৬ টি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হলো, বন্ধের পথে চিনিকল। বকেয়া চাইতে গিয়ে বাঁশখালীতে জীবন দিতে হলো ৭ শ্রমিককে, রক্ত ঝরালেন আরো ৫০ জন। অতএব পরিষ্কার পুঁজিপতিদের কাছে শ্রমিকের জীবনের গ্যারান্টি নেই, তাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। বাঁচলেও চলতে হবে পুঁজিপতিদের দাসদের মতো।
করোনাও হয়তো চলে যাবে! কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে যাবে। তাদের জীবনে নেমে আসবে আরো ভয়ঙ্কর দিন। কিন্তু কেন? কেন বার বার শ্রমজীবী মানুষ নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হবেন? কেন তার অধিকার বঞ্চিত হবেন?-এ প্রশ্নকে এবার সামনে আনছেন শ্রমজীবী মানুষ। তারা ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তা খুঁজছেন। কিন্তু ভরসা ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল পাচ্ছেন না। লুটেরাদের চক্রান্তে শ্রমিক সংগঠনগুলো দ্বিধাবিভক্ত। কেউ মালিকের দালালি করে, কেউ এনজিওর দালালি করে। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু শ্রমিক সংগঠন প্রকৃতপক্ষেই শ্রমিক শ্রেণির অধিকার আদায়ে লড়াই করে। তারা এবং তাদের বন্ধু সংগঠন বামপন্থী রাজনৈতিক দল বিকল্প গড়তে চায়। তারা চায় শ্রমজীবী মানুষের শোষণমুক্তি। তার জন্য শ্রমিক শ্রেণিকে এগিয়ে আসতে হবে। রক্তমাখা লাল পতাকাটাকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। এবারের নীরব উৎসবে শ্রমজীবী মানুষ বুঝেছেন, “দুনিয়ার মজদুর এক হও”-এই শ্লোগান সব শ্রমিক সংগঠন দিলেও, সব মিছিলে এদিন লাল পতাকা থাকলেও কেউ শ্রমিকের মাথা বিক্রি করে স্বার্থ হাসিল করে, আর কেউ প্রকৃতপক্ষেই শ্রমিকের মুক্তির জন্য জানবাজি রাখে। এবার শ্রমিকরা বুঝেছে জানবাজি রাখা রক্তমাখা লাল পতাকা’ই তাদের মুক্তির দিশারী। এটাই শেষ ভরসা। তাই এবারের মে দিবসে অঙ্গীকার হোক-‘শ্রমিক ঐক্য, সংহতি ও লড়াইয়ের নব চেতনা’ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। লাল সালাম দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষ।

সর্বশেষ