শনিবার,২৭,এপ্রিল,২০২৪
29 C
Dhaka
শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়স্মরণার্ঘ্যশ্রমিকনেতা কমরেড হাফিজুর রহমানকে প্রথম যেদিন  দেখেছি

শ্রমিকনেতা কমরেড হাফিজুর রহমানকে প্রথম যেদিন  দেখেছি

।। ড. সুশান্ত দাস ।।

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ কমরেড হাফিজুর রহমান  আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এবার তাঁর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন এদেশের ৬০এর দশকের ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক আবহে গড়ে ওঠা তরুণ যারা তাঁদের তথাকথিত রঙিন স্বপ্ন ছেড়ে শ্রমজীবি মানুষের মুক্তির লড়াইএ নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সামনের সারিতে থাকা একজন। তিনি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই প্লাটিনাম জুটমিলে কাজ নিয়েছিলেন, চাকরি নয় এবং প্লাটিনাম জুটমিল শুধু নয়, বাংলাদেশের জুটশ্রমিকদের প্রাণপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর শেষ বিদায়ের দিন যারা প্লাটিনাম জুট মিলে  উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা তা দেখেছেন, নেতার প্রতি সাধারণ শ্রমজীবি  মানুষের শ্রদ্ধার রূপ কি। প্লাটিনাম জুট্মিলসহ দেশের ২৬ টি রাষ্ট্রায়ত্ব জুট্মিল বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে আর নাই শ্রমিকদের শ্লোগান, নাই উত্তোলিত হাত তুলে প্রতিবাদের অবিনশ্বর ভাষা। কিন্তু, সম্ভবতঃ এখনো কমরেড হাফিজুর রহমানের নাম উচ্চারিত হয়, নিভৃতে পক্ককেশ কোন ছাটাই হওয়া শ্রমিকের কুড়েঘরের  কোণে।  মনে মনে আশায় থাকে হয়তঃ কমরেড হাফিজ আবার ডাক দিয়ে বলবেন,’ভায়েরা, আমাদের দাবী আদায় না করে ঘরে ফিরবো না, অথবা বলবেন, আওয়াজ তোল ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, আমাদের দাবী মানতে হবে’। হয়তঃ প্লাটিনাম, ইষ্টার্ন, আলিম বা বন্ধ হয়ে যাওয়া মিলগুলোর আঙ্গিনা ছেড়ে, নতুন গড়ে ওঠা কোন শিল্পাঞ্চলে বা কোন অপ্রাতিষ্ঠানিক কোন শ্রমিকের বেঁচে থাকার লড়াইএ, হাফিজুর রহমান থাকবেন না শারীরিকভাবে, এমনকি  হয়তঃ নামেও, তবুও থাকবেন তাঁদের লড়াইএ। এটাই ইতিহাসের বিধান।

আমার সঙ্গে কমরেড হাফিজুর রহমানের সাক্ষাৎ দেখা ১৯৭৬ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব শেষে, ছাত্র রাজনীতি শেষ করে,  সার্বক্ষণিক পার্টি কর্মীর তকমা লাগিয়ে তখন রাজশাহীতে থেকে গিয়েছিলাম। কখনো আখচাষীদের মধ্যে, কখনো কমরেড  ইলা মিত্রের নাচোলের সাঁওতাল চাষীদের মধ্যে, কখনো ছাত্রদের মধ্যে তাঁদের সংগঠিত করার কাজে ছুটছুটি করছি। হটাৎ করেই দ্বিতীয়বার পেটের আলসারে রক্তক্ষরণ শুরু হল। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও ডাক্তাররা বললেন, বিশ্রাম না নিলে, বেঁচে ওঠা মুস্কিল। পরিবার পরিজন নাই, পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী। কোথায় হবে বিশ্রামের জায়গা। তখন কেন্দ্রিয় কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছি। অনেক বিবেচনার পর ঠিক হল খুলনা জেলায় যাওয়া হবে। সত্যি বলতে কি, তখন খুলনা অঞ্চলে শ্রমিকদের মধ্যে কাজের কথা শুনেছি এবং শ্রমিক নেতা হিসেবে কমরেড হাফিজুর রহমানের নাম  শুনেছি। কমরেড নজরুল ইসলাম ছিলেন তখন পার্টির নেতা। শুনেছি কৃষকনেতা হিসেবে কমরেড কামরুজ্জামান লিচুর নাম। এদের সবার কথা আলাদা করে হয়তঃ লিখতে হবে। খুলনা জেলার অন্তর্ভূক্ত বাগেরহাট মহকুমার, মোংলা থানার ছোট্টগ্রাম হলদিবুনিয়ায় আশ্রয় নিলাম। ছিলাম আট মাস একেবারেই অন্তরীণের মত। পার্টি নির্দেশে ফিরে যাবার সময় হলো। এলাম দৌলতপুরে কমরেড নজরুল ইসলামের বাসায়। বাসা বলার চেয়ে কমিউন বলা ভালো। নজরুল ভাইয়ের ভাগ্নে বাচ্চু ছিল তখন। পরদিন সকালে ট্রেন রাজশাহী যাবার কথা । ছোট একটা ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নজরুল ভাইকে বললাম, ‘নজরুল ভাই, আমি যাচ্ছি’। নজরুল ভাই ঘুম থেকে ওঠেননি, তিনি দেরি করে ঘুম থেকে উঠতেন সব সময়। তিনি ঘুম ঘুম স্বরেই বললেন, ‘রাজশাহী কি যেতেই হবে?’। আমি বললাম, ‘তাইতো বলা হয়েছে’। তিনি বললেন, ‘খুলনায় থেকে যাও’। যার ঘর নাই, বাড়ি নাই, তার আবার পছন্দের কি আছে? রাজী হয়ে গেলাম একবাক্যে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, মনের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা ছিল শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করবো। তখনো তার কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। থাকার জায়গাও ঐ নজরুল ভাইয়ের কমিউনে। ভবিষ্যত কি তাও অজানা। থেকে গেলাম। শুরু হলো আজকের জীবনের জন্য শুরুর অধ্যায়। যতদূর মনে পড়ে, সেদিন বিকালেই, খুলনা জেলা কমিটির মিটিং ডাকা হলো। বুঝলাম। কমরেড নজরুল  ইসলাম আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। বিকালে চারজন কমরেড উপস্থিত হলেন। কমরেড কামরুজ্জামান লিচু, আমাদের লিচুভাই। ছোটখাট মানুষ। সদা হাস্যময়। প্রথম  দেখেই মনে হয় বড় হৃদয়ের মানুষ। পরে যা দেখেছি জীবন দিয়ে। সাদা পাঞ্জাবী আর লুঙ্গী পরা। কমরেড ওয়াহিদুজ্জামান, যিনি খুলনায়  জামান ভাই নামে সর্বজন পরিচিত ছিলেন। এককালের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা, তুখোড় বক্তা। কমরেড রণজিৎ দত্ত, তিনিও খুলনার প্রখ্যাত ছাত্র নেতা। পরবর্তীকালে জীবন দিয়ে দেখেছি, তিনি ছিলেন আমার দেখা পৃথিবীর অন্যতম স্বচ্ছ মানুষ। যিনি খারাপ হওয়া তো দূরের কথা, খারাপ ভাবতেও জানতেন না। আর সবার শেষে এলেন কমরেড হাফিজুর রহমান। অসম্ভব সুন্দর চেহারা, ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবী পরা । কল্পনায় ছিল শ্রমিক নেতা হবেন এলোমেলো জামা কাপড়, বিস্রস্ত চুল, ছেঁড়া চটি পড়া, সদা তটস্থ এক চেহারা। কিন্তু বাস্তবে তা মিললো না। এই মানুষ যেমন সুদর্শন, হাস্যময়, তেমনি সুবেশধারি এবং ঘরে ঢুকেই বললেন,’লিচু ভাই, একটা দাও’। লিচু ভাই মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ‘আমার কাছে একটাই আছে, আর নাই।‘ বলে সিগারেটের বাক্সটা ফেলে দিলেন মেঝেয়। হাফিজ ভাই, আস্তে করে প্যাকেটটা তুলে, একটা সিগারেট বের করে, পুরো প্যাকেটটা পকেটে ভরলেন। লিচু ভাই বললেন, ‘তুই প্যাকেটটা পকেটে ভরলি ক্যান?’ হাফিজ ভাই হেসে বললেন,’তুমি তো ফেলে দিয়েছ’। সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আমি অবাক চেয়ে রইলাম। এই মানুষগুলোর সঙ্গে আমার জীবন একসংগে গাঁথা হলো। অনেক সুখে দুঃখে, আনন্দ বেদনায়, সংগ্রামে-সংগঠনে এদের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম।

ফিরে আসি হাফিজ ভাইয়ের কথায়। বৈঠকে আমাকে জেলা কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করা হলো। তখন আমি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফলে গঠনতান্ত্রিক অসুবিধা নাই। তবে পার্টির (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী), তখনো ওয়ার্কার্স পার্টি নাম হয়নি) জেলা সম্পাদকের সাংগঠনিক কাজের দায়িত্ব দেওয়া হল। অবাক হবার মত ঘটনা। আজকে যখন দেখি, পার্টির নেতৃত্ব নেবার জন্য কত প্রতিযোগিতা কাড়াকাড়ি, তখন অবলীলায় একজন বলতে গেলে অপরিচিত সর্বকনিষ্ঠ একজনকে এই দায়িত্ব দেওয়া হলো। কেউ দ্বিমত করলেন না। পরে দীর্ঘ একযুগে দেখেছি, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব সম্পর্কে এই মানুষগুলোর ধারণা কত স্পষ্ট ছিল। কমরেড হাফিজ প্রথম দিনে দৃশ্যতঃ কোন উচ্ছাস দেখালেন না। শুধু বললেন, দাদা ( তিনি আমার বয়সে বড় হলেও আমাকে দাদা বলতেন ও আপনি বলতেন) কালকে একবার প্লাটিনামে আসতে পারবেন?’ আমি রাজি হলে গেলাম। পরদিন প্লাটিনামের গেটে শ্রমিক নেতা (!!) হাফিজুর  রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আজকে শুধু সেই কথাটাই বলবো।

মনে আছে, সকাল দশটার দিকে প্লাটিনাম জুবিলি জুটমিলের গেটে পৌছালাম। তখন হেঁটে যেতে হতো। (পরবর্তীকালে আমার হাঁটা নিয়ে একটা রসিকতা চালু হয়েছিল। আমার পায়ে অক্ষয় চপ্পল না থাকলে নাকি আমার পা ক্ষয় হয়ে গলা পর্যন্ত চলে যেতো) । যেয়ে দেখি হাফিজ ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। চারপাশে ভীড় করা শ্রমিকরা। আমাকে দেখেই তিনি বললেন,’দাদা চলেন’, বলে হাঁটতে শুরু করলেন। কারুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন না, ভালো মন্দ কিছু বললেন না। আমি একটু অবাক হলাম। কিছুটা মনক্ষুন্নও  হলাম। পরবর্তীকালে বুঝেছিলাম, তিনি আমাকে তার মাধ্যমে পরিচিত করাতে চাননি। আমি নিজেই যেন তাঁদের মধ্যে পরিচিত হয়ে উঠি, তাই চেয়েছিলেন।  তিনি জানতেন, শ্রমিকদের মধ্যে কারুর মাধ্যমে পরিচিত হওয়া যায় না কাজ দিয়ে, তাঁদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরিচিত হতে হয়।

ফিরে ইউনিয়ন অফিসে এসে বসলাম। সাথে যথারীতি অনেক শ্রমিক ভাইয়েরা। তাঁরা স্বাভাবিকভাবে তাঁদের নেতার সঙ্গে কথা বলতে চান। কমরেড হাফিজ কিছুটা রূঢ়ভাবেই বললেন,’ বাবর আলী তোরা ৪ জন একটু বস, বাকীরা যা, পরে কথা বলবো।‘ দেখেছি তিনি সবাইকে তুই সম্বোধন করতেন। এটা যদি বদভ্যাস হয়, তা পরবর্তীকালে আমারো হয়েছিল। খুলনা এলাকার অনেক বয়োজ্যষ্ঠ নেতাদের আমি এখনো তুই বলি। এই ভুলটা কমরেড হাফিজুর রহমান আমাকে শিখিয়েছিলেন। আমি তারজন্যে তাঁকে কোনদিন দোষারোপ করিনি।  তাঁর মত তাঁদের নেতা হতে পারিনি, কিন্তু তাঁদের আপনজন হতে পেরেছিলাম।  বাবর আলী এখন কোথায় আছে জানি না। সে তখন সেখানে পার্টির সদস্য ছিল। শ্রমিক, ভাল করে সে কোনদিন পড়তে শেখে নাই। কিন্তু তার সাংগাঠনিক ক্ষমতা ছিল দারুন। সাহসও ছিল।  বাবর আলীর সঙ্গে পরবর্তীকালে বহু আন্দোলন সংগ্রামে সহযোদ্ধা থাকতে হয়েছে। চারজনকে নিয়ে কমরেড হাফিজ বললেন, ‘আজ থেকে পার্টির সব দায়িত্ব দাদার। দাদার লগে কথা কইবি।‘ তাঁর রাজনীতির পরিচয় শেষ। এরপর প্রায় ১২ বছর এই এলাকার আন্দোলন সংগ্রামে পার্টি সামনের সারিতে ভূমিকা রেখেছে। কোনদিন শ্রমিক গ্ণসংগঠনের সঙ্গে পার্টির কাজের  সমন্বয় হয়নি এমন ঘটনা কদাচিৎ ঘটেছে। কমরেড জাফিজুর রহমান তারপর পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, পলিটব্যূরোর সদস্য,  শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু ঐ জে জে আই থেকে খালিশপুরের সকল শ্রমিকদের কাছে তিনি চিরকাল নিজের মানুষ থেকেছেন। আমি প্রথম দিনই বুঝেছিলাম, এই মানুষ এদের নিজের মানুষ, তাঁদের সহযোদ্ধা, তাঁদের নেতা। কমরেড হাফিজুর রহমানকে কোনদিন নেতা হবার প্রতিযোগিতায় নামতে দেখিনি, যা দেখিনি প্রথম দিন, তা দেখিনি শেষদিনও। কিন্তু তিনি নেতাই ছিলেন। পার্টির বহু বড় বড় নেতা তাঁর সঙ্গে সমীহ করে কথা বলতেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সবচাইতে স্বল্পবাক মানুষ ছিলেন। কিন্তু, যা বলতেন তার ব্যত্যয় হওয়া কঠিন ছিল।

১৯৭৬ সাল থেকে তাঁর মৃত্যুর দিনতক তাঁর সঙ্গে যে নিবিড় বন্ধুত্বে আবদ্ধ হয়েছি, তা কোনদিন ছিন্ন হয়নি। তাঁর মা, তাঁর বোনেরা, তাঁর ভাই এরা আমার নিজের পরমাত্মীয় ছিলেন। তাঁর সন্তানেরা, তার ভাইবোনের সন্তানেরা কোনদিন আমাকে পরিবারের বাইরে ভাবেনি। দীর্ঘ চার দশকে আমরা বহু রাজনৈতিক ভাঙ্গাগড়া টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছি, কোনদিন আলাদা হইনি। তিনি প্রথম দিন থেকে সহযোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, শেষদিনও তা রক্ষা করেছেন। এমনকি, দিল্লী থেকে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্তেও তিনি পার্টির সিদ্ধান্তকেই মেনেছেন এবং তাঁর পরিবার আমার সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।  তিনি দেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েছিলেন।

কমরেড হাফিজেরা কোনদিন মৃত্যুবরণ করেন না। কমরেড হাফিজ যুগ যুগ জিও। লাল সালাম।

লেখক : পলিটব্যুরোর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি

সর্বশেষ