বৃহস্পতিবার,২,মে,২০২৪
30 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মে ২, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়সাম্রাজ্যবাদী জোয়াল ছিন্ন করতে মার্কসবাদের বিকল্প নেই

সাম্রাজ্যবাদী জোয়াল ছিন্ন করতে মার্কসবাদের বিকল্প নেই

।। শরীফ শমশির ।।

শরীফ শমসির

দুনিয়ার বিপ্লবী ইতিহাসে একটি অনন্য নাম কার্ল মার্কস । ১৮১৮ সালের ৫ মে জার্মানে জন্ম নেওয়া এই মহান বিপ্লবী বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে পরিচিতি মহামতি কার্ল মার্কস নামে। যার জন্ম একটি যুগান্তকারী ঘটনা। সারা দুনিয়ায় সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী বিপ্লবীদের প্রেরণা কার্ল মার্কস, যাকে ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রভাব বিস্তারকারী চিন্তক’-বলেছে বিবিসির জরিপ প্রতিবেদন। পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী মহল এবং মিডিয়াগুলো যখন প্রশ্ন তুলেছিল সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পরে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা কি তখনো পৃথিবীর দেশে দেশে মার্কস অধ্যায়ন বেড়েই যাচ্ছিল। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো কেন তাদের অর্থনৈতিক মন্দা বা মহাধ্বংস এড়াতে পারছে না তা অনুসন্ধান’ই এই অধ্যায়নের প্রধান কারণ।
কার্ল মার্কস তার নানা গ্রন্থে কেবল পুঁজিবাদী অর্থনীতির পর্যালোচনাই করেননি, মার্কসকৃত প্রায় সকল নোট যতই অধ্যয়ন করা হচ্ছে ততই বিপ্লব প্রতিবিপ্লব, ফ্যাসিবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নারীবাদ, জাতীয়তাবদ, জাতি সমস্যা, অ-পশ্চিমা সমাজ এবং পরিবেশ বিষয়ে ও তার চিন্তা এখনো প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হচ্ছে। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস’র যৌথ চিন্তা বিপ্লবী রাজনীতিতে মাকর্সবাদ হিসেবে পরিচিত আর তা গত শতাব্দীজুড়ে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন বিপ্লবে নয়, তৃতীয় বিশে^র প্রায় সকল দেশের জাতীয় মুক্তি ও উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের প্রধান প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। দেশে দেশে মার্কসবাদ মানবমুক্তির মতবাদ হিসেবে খ্যাত হয়ে আছে। মার্কসবাদের তিনটি অঙ্গ-দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতির পর্যালোচনা। মার্কসীয় দর্শনে রয়েছে দার্শনিক বস্তুবাদ, দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব ও ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা। মার্কসীয় রাজনীতিতে রয়েছে শ্রেণী সংগ্রাম, শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব, সমাজতন্ত্র এবং অর্থনীতিতে রয়েছে মূল্য, উদ্বৃত্ত মূল্য ইত্যাদি। কার্ল মার্কস ‘আধুনিক সমাজে’র অর্থাৎ পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সমাজের গতিধারার অর্থনৈতিক নিয়ম উদ্ঘাটন করার লক্ষ্যে রচনা করেছেন ‘পুঁজি’, যা এখনো চিন্তার নতুন নতুন খোরাক যুগিয়ে যাচ্ছে।
কার্ল মার্কস একই সঙ্গে সমাজের অর্থাৎ মানব-ইতিহাস বিকাশের সূত্র আবিষ্কার করেছেন। অর্থনীতি ও সমাজ বিকাশের সূত্র আবিষ্কার করা ছাড়াও কার্ল মার্কস ছিলেন একজন বিপ্লবী। ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ভাষায়, কার্ল মার্কসের জীবনের সত্যিকার লক্ষ্য ছিল পুঁজিবাদী সমাজ এবং এই সমাজ যে সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে সেগুলোর উচ্ছেদে কোনো না কোনোভাবে অবদান রাখা। আধুনিক শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্ব ও তাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের সচেতন করেন; তিনি তাদের মুক্ত করার আন্দোলনে অবদান রাখতে চেয়েছিলেন। লড়াই করা ছিল তার বৈশিষ্ট্য। এঙ্গেলসের এই মূল্যায়ন আজ শতভাগ প্রমাণিত। মার্কসবাদ দেশে দেশে মানবমুক্তি যেমন নিশ্চিত করেছে, তেমনি পুঁজির শোষণের জোয়াল থেকে শ্রমিক শ্রেণিকে মুক্তির পথের দিশাও দিয়ে যাচ্ছে।
জার্মান চিরায়ত দর্শন, ইংরেজি চিরায়ত অর্থনীতি এবং ফরাসী সমাজতন্ত্র বা সাধারণভাবে ফরাসী বিপ্লবী মতবাদ থেকে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকেই কার্ল মার্কসকে ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তক হিসেবে তার সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করলেও কালের প্রবাহে তার বিভিন্ন রচনাবলী থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে উপনিবেশ ও ভারত বিষয়ে মার্কসের মহৎ ভাবনাগুলো সময়ের বিবর্তনে পূর্ণতা লাভ করেছিল। তার এই চিন্তাগুলোই উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে পথ দেখিয়েছিল।
কার্ল মার্কস উপনিবেশ নিয়ে তার চিন্তার প্রসার ঘটিয়েছিলেন পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মূল কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করার জন্য। তিনি আয়ারল্যান্ড, চীন ও ভারত বিষয়ে তার গভীরতর পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছিলেন নানা নিবন্ধ, প্রবন্ধ, পত্রাবলী’সহ পুঁজির প্রথম খণ্ডে। এছাড়াও দি জার্মান ইডিওলজি, গ্রুন্ড্রিস এবং নোটস অন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি (১৬৬৪-১৮৫৪) তে। আমেরিকার প্রগতিশীল সংবাদপত্র নিউইর্য়ক ডেইলি ট্রিবিউন পত্রিকায় ১৮৫৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ভারত প্রসঙ্গে মার্কসের নিবন্ধগুলোও প্রণিধানযোগ্য। ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত মার্কস উক্ত পত্রিকায় ২১ টি নিবন্ধ লিখেছিলেন ভারত প্রসঙ্গে। এসব নিবন্ধ এবং অন্যান্য রচনায় ভারত প্রসঙ্গে মার্কসের ধারণা পুনঃ পুনঃ পরিবর্তিত হয়েছিল। মার্কস-এঙ্গেলস পত্রাবলী থেকে জানা যায় ভারত প্রসঙ্গে মার্কস প্রথম দিকে হেগেলের দৃষ্টিভঙ্গিতে আচ্ছন্ন ছিলেন। কিন্তু বার্নিয়ের রচনাবলী, ব্রিটিশ সরকারের ১৮১১ সালের প্রকাশিত ফিথ রিপোর্ট, ফ্রম দি কমিটি অন দি অ্যাফেয়ার্স অফ দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, কর্নেল উইলকস এর হিস্টোরিকাল স্কেচেস অফ সাউথ ইন্ডিয়া, এলফিন স্টোন এর ‘ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’ জন ক্যাম্পবেল ‘আধুনিক ভারত ১৮৬২’ জেমস মিলের ‘ ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস (১৮০৬-৬৮) এবং ব্রিটেনের সংসদীয় বিতর্ক ও আইন ইত্যাদি অধ্যয়ন করে তার নিজস্ব ধারণা গড়ে তোলেন। এঙ্গেলসের সঙ্গে মার্কসের পত্র বিনিময়েও তার চিন্তার গঠন অনুধাবন করা যায়। এক পত্রে মার্কস লিখেছেন, প্রাচ্যের ইতিহাসকে কেন একটা ধর্মীয় ইতিহাস বলে মনে হয়। এখানে এসেও মার্কস বলছেন, ভারতের অসাধারণত্ব ধর্মের মধ্যে নয়, ভারতের সংস্কৃতির অসাধারণত্ব আসলে ভারতের সামাজিক সংগঠন তথ্য গ্রামীণ গোষ্ঠী-সমাজের ফল।
ভারত প্রসঙ্গে মার্কসের চিন্তার অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম হলো ভারতের প্রাক-উপনিবেশিক সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি অনুধাবন, পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশে উপনিবেশের বিস্তার , ভারতে উপনিবেশিক শাসনের ফলাফল, ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামে (১৮৫৭) ভারতীয় জনগণ ও ব্রিটিশ শাসকদের ভূমিকা এবং সর্বোপরি ব্রিটেনের ভারত লুণ্ঠন, শোষণ ও শাসনের চিত্র।
মার্কস ভারতকে এশীয়ধাঁচের উৎপাদন পদ্ধতির অধীন মনে করতেন। একারণে তিনি ভারতের গ্রামীণ সমাজের বিষয়ে অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। মার্কস “জমির ওপর সাধারণ অধিকার” এর প্রাধান্যকে ভারতীয় গ্রার্মীণ গোষ্ঠীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখতেন। ভারতের বর্ণভেদ প্রথা সম্পর্কে মার্কসের মন্তব্য ছিল এই প্রথা বংশানুক্রমিক ব্যক্তি-কারিগর, সূত্রধর, ধাতুকার এবং এমন অনেক যোগানদার তৈরি করব। নির্দিষ্ট শ্রমের সামাজিক বিভাজনের যেকোনো পরিবর্তনকে নিষিদ্ধ করে গ্রামীণ গোষ্ঠী তার কারিগরকে এই বাজারটি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল।
মার্কসের মতে, এশীয় ধাঁচ সুদৃঢ়ভাবে দীর্ঘসময় ধরে উপযোগিতায় টিকে থাকে। এর ফলে গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যক্তিসত্তা কখনো স্বাধীন হবে না ; কৃষি, হস্তশিল্প ইত্যাদির সমন্বয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়াটি থাকবে স্বতঃবহমান। তাই মার্কস গ্রামীণ গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে দাসত্বের অসিস্ত¡ লক্ষ্য করেছিলেন। গোটা গোষ্ঠীকে শোষণ করে তাই বিজয়ীরা উদ্বৃত্ত আদায় করত। এই শোষণ প্রক্রিয়াকেই মার্কস এশিয় স্বৈরতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মাকর্স ‘পুঁজি’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন ইউরোপে শিল্প পুঁজিপতিদের উদ্ভবে উপনিবেশের ভূমিকা রয়েছে। ইউরোপ অর্থনৈতিক ও সামরিক বল প্রয়োগ করে উপনিবেশের সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন প্রণালীকে দ্রুতগতিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালীতে রূপান্তর করেছে। উপনিবেশের বাজার যেমন তারা দখল করে, তেমনি রাজনৈতিক শাসনের পাশাপাশি বাণিজ্যও দখল করে নেয়। ভারত এর ব্যতিক্রম নয়। ব্রিটিশরা ভারত থেকে সম্পদও পাচার করে। ভারতের সম্পদের উদ্বৃত্ত ইংল্যান্ডে পাচার হয়। মার্কসের মতে, ব্রিটেনকে দেয় সুদ, খাজনা, পেন্সন এবং ভারতস্থ ব্রিটিশ নাগরিকদের স্থানান্তরিত সঞ্চয়-সবই সম্পদ পাচারের অন্তর্ভূক্ত। মার্কসের মতে ব্রিটিশপূর্ব বহিরাগতরা ভারতের শুধু ওপর তলায় প্রভাব ফেলত, কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব ভারতের অভ্যন্তরেও পড়েছিল। মাকর্সের মতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল ছিল দ্বৈত। একটি ধ্বংসের অন্যটি পুনর্জাগরণের। তার মতে, ব্রিটিশ শাসনের ফলে ভারতে পুরনো এশিয়াটিক সমাজের বিনাশ হয়েছে এবং অন্যদিকে পশ্চিমা সমাজের বস্তুবাদী ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। ভারতে রেল ব্যবস্থাকে মার্কস বেশ ইতিবাচকভাবে দেখেছিলেন। রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আধুনিক শিল্প ভারতবর্ষের বর্ণভেদ প্রথারও অবলুপ্তি ঘটাবে এমন মনে করতেন মাকর্স।
ভারত বর্ষের মানুষের জাগরণও মার্কস লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে সামরিক বিদ্রোহ হিসেবে না দেখে একটি জাতীয় বিদ্রোহ হিসাবই দেখেছিলেন। তার মতে এই বিদ্রোহ ছিল ভারতের জনগণের বিপুল অংশকে নিঃস্ব করে দেওয়ার পদ্ধতির বিরুদ্ধে, পুরনো জীবনযাপন পদ্ধতির অবলুপ্তির অভিব্যক্তি হিসেবে। তবে ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তির সফলতা দেখেছিলেন শুধু ভারতবর্ষে নয় ব্রিটেনের অভ্যন্তরেও পুজিপতিদের পরাজয়ের মধ্যে। তিনি লিখেছেন, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বুর্জোয়ারা ইতস্তত যে নতুন সামাজিক উপাদানের বীজ বপন করেছিল ভারতবর্ষের মানুষ ততোদিন সে ফসল নিজ খামারে তুলতে পারবে না, যতদিন না গ্রেট ব্রিটেনের অভ্যন্তরে শিল্প-সর্বহারারা সেখানকার শাসক শ্রেণির স্থলাভিষিক্ত হয় অথবা ভারতের অধিবাসীরা আপন ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে ব্রিটিশ শাসনের জোয়াল ছুড়ে ফেলে।
ভারতবর্ষ সম্পর্কে মার্কসের চিন্তা পদ্ধতি এখনো সমান বিশ্লেষণ যোগ্য যখন অভ্যন্তরীণ শ্রেণী সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিকতার সমন্বয় কৌশল আমাদের অধীত বিষয় হবে। আজকের বাংলাদেশেও সাম্রাজ্যবাদী জোয়াল ছিন্ন করে দেশের অভ্যন্তরে মেহনতী শ্রেণীর শাসন কায়েমের জন্য কার্ল মার্কস চর্চার কোনো বিকল্প নেই।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

সর্বশেষ