শনিবার,২৭,এপ্রিল,২০২৪
30 C
Dhaka
শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়মুক্তমতসুবর্ণজয়ন্তী ও মে দিবস: শ্রমিক সংহতির বিকল্প নেই

সুবর্ণজয়ন্তী ও মে দিবস: শ্রমিক সংহতির বিকল্প নেই

।। শরীফ শমশির ।।

শরীফ শমসির

শুরু থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনা ছিল কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি। ’৫৪-তে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা, ’৬৯-এ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা, এমনকি ছয় দফার মধ্যেও এ অঙ্গীকার ছিল। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছেন শ্রমিক-কৃষক। তার’ই আলোকে ’৭২-এ সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে কৃষক-শ্রমিক ও অনগ্রসর অংশ সমূহের শোষণ মুক্তির অন্যতম মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি। শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির বিষয়টি বহুমাত্রিক। শ্রমিকের মুক্তি হলো অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মুক্তি ও তার শোষণ থেকে সার্বিক মুক্তি। এর মধ্যে তার অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও স্বীকৃত। বাংলাদেশ শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা সহ তাদের সার্বিক মুক্তির বিষয়েও অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু তা কেবল সংবিধানেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবায়নে গৃহিত পদক্ষেপসমূহ খুবই অপ্রতুল, কখনো কখনো তা বিরোধাত্মক। পুঁজি বা পুঁজিপতিদের স্বার্থে বিভিন্ন নীতিমালা সুরক্ষিত করতে গিয়ে শ্রমিকের মৌলিক মানবাধিকারও খর্ব হচ্ছে। শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্বে রাষ্ট্রের পক্ষপাতমূলক আচরণ, নীতি বা পদক্ষেপ শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রকেও সংকুচিত করছে এবং মুক্তির বিষয়টিকে আরো দুরূহ করে তুলেছে। সংবিধানের মৌলিক অঙ্গীকার থেকে রাষ্ট্রের এই বিচ্যুতি শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনের অনুপস্থিতিকেও দায়ি করা হয়। কারণ স্বাধীনতার আগে যে শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন ছিল, তা আজ বহুধাবিভক্ত, দুর্বল এবং সংস্কারমুখী।
এদেশে শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি সামনে আসে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। ব্রিটিশ ভারতের বাংলায় তখন চা বাগানের গোড়াপত্তনের জন্য ব্যাপকহারে শ্রমিক অভিবাসনের কাজটি দাস প্রথার ছদ্মাবরণে শুরু হয়। ১৮৭৫-এ ব্রিটিশ সরকার ফ্যাক্টরি বিষয়ে কমিশন গঠন শুরু করলেও তার কার্যকারিতা তেমন ছিল না। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদ আন্দোলন শুরু হলে শিল্প কারখানায় শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘবে মানবতাবাদী নেতাগণ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলায় তা বৃহৎ অর্থে চা-শ্রমিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের প্রভাবে ১৯২০-২১ সালে সমাজতন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদীদের সমন্বয়ে সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস গঠিত হয়। ’৪৭-এ ভারত ভাগের আগ পর্যন্ত বাংলায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থীদের স্পষ্ট ছাপ ছিল। ১৯২০-২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ শ্রমিক আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন দেয়। ১৯২১ সালে চাঁদপুরে চা-শ্রমিকদের নির্যাতনের প্রতিবাদে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল, সেই লড়াইয়ের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রী বা বামপন্থীরা শ্রমিকদের কারখানাভিত্তিক ধর্মঘট ও ইউনিয়ন সংগঠনের দিকে বেশি মনোযোগী ছিল। ব্রিটিশ সরকার ১৯২১ এ ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন আইন প্রবর্তন করে শ্রমিক ইউনিয়নের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এতে করে শ্রমিক ইউনিয়নের রেজিষ্ট্রেশন শুরু হয় এবং ১৯২৯-এ শ্রমবিরোধ বিষয়ক আইন প্রণয়ণ করে সরকার হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করে। শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠনে এবং ধর্মঘট আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীরা আইনের পথ বেছে নেয়। অন্যদিকে বাপন্থীরা আন্দোলন ধর্মঘটে শ্রমিকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় জোর দিলে সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ভেঙ্গে শ্রমিক আন্দোলন দুটি ধারায় বিভক্ত হয়। ’৪৬-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি বোম্বে প্রায় ২০ হাজার নৌ সিপাহীর অংশগ্রহণে ব্রিটিশ ভারতীয় নৌবাহিনীর সিপাহী বিদ্রোহে সারা ভারতের জনগণ সমর্থন দেয়। ওই ধর্মঘটে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন দিয়েছিল কিন্তু কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ তা দমনে সমর্থন দেয়। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী শক্তি প্রয়োগে ৮ জন নিহত এবং ৩৬ জন আহতের মধ্যদিয়ে ওই বিদ্রোহ দমন করে। নৌ সিপাহীদের ওই ধর্মঘট ব্রিটিশ রাজত্বকে কাঁপিয়ে দিলেও শ্রমিক সংগঠনগুলো তাদের সমর্থনে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে পারে নি। ফলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন উপনিবেশিকতা বিরোধী চরিত্র ধারণ করলেও প্রয়োজনীয় শ্রমিক সংহতি ও রাজনৈতিক সমর্থনের অভাবে তা নির্মমভাবে দমিত হয়। তাই ’৪৭-এ ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার সংগ্রামে শ্রমিক আন্দোলনের গৌরবজনক ভূমিকা থাকা স্বত্ত্বেও কোনো ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী ধারা হিসেবে নিজেদের ধারাবাহিকতা রাখতে পারে নি।
শ্রমিক আন্দোলন পাকিস্তান সৃষ্টির ঐতিহ্যের উত্তারাধিকার হলেও কোনো সত্যিকার শ্রমিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা রাষ্ট্রের সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই সৃষ্ট সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের অভিমূল ছিল ভাষা, খাদ্য এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন আন্দোলন-ধর্মঘট হলেও শিল্প শ্রমিকদের তেমন কোনো সক্রিয়তা দেখা যায় নি। তার কারণ হলো পূর্ব বাংলা ভৌগলিকভাবে বৃহৎ শিল্পের বড় কোনো উত্তরাধিকার পায় নি। পায়নি পাট, স্টিল এবং পেপার মিলের কোনো ইউনিট। পেয়েছে শুধুই ৯০টি স্পিনিং মিল, ১০০টা সুগার মিল, ৩ টা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি; যেগুলোর কাঁচামালের জন্য আসামের ওপর নির্ভর করতে হতো। ’৫১-র সেমসাস রিপোর্ট অনুসারে পূর্ব বাংলায় অকৃষি শ্রমিক ছিল ৬৩২৩৪। এর মধ্যে মাত্র ৪.৭% ছিল উৎপাদন খাতে। বেশিরভাগ শ্রমিক কাজ করতেন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে। পাকিস্তান সরকার সামরিক সরঞ্জাম, জলবিদ্যুত শক্তি, রেলওয়ে, ওয়াগন, টেলিফোন, টেলিগ্রাম ও ওয়ার্লেস সরকারি খাতে রেখে অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের সুযোগ রেখে শিল্পনীতি ঘোষণা করে। সরকার পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন এবং পাকিস্তান ফাইন্যান্স কর্পোরেশন তৈরি করে শিল্পায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। পরিকল্পনা কমিশন পাট, টেক্সটাইল, সিল্ক ও রেয়নসহ ২৪ টি ক্যাটাগরির শিল্প তৈরি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভূক্ত করে। কিন্তু এই নীতিমালায় পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক ধারা ছিল। যেমন, পুঁজিধন শিল্প পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপিত হবে; পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত শিল্পের পুঁজি পূর্ব বাংলায় অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বিনিয়োগ হবে এবং পূর্ব বাংলার শিল্পের উৎপাদিত পণ্য পশ্চিম পাকিস্তানের ভোক্তাদের চেয়ে বেশি দামে ক্রয় করবে পূর্ব বাংলার ভোক্তারা। এই বৈষম্যমূলক নীতির মধ্যে পূর্ব বাংলায় যে শিল্প গড়ে ওঠে তার অধিকাংশের বিনিয়োগকারী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে পূর্ব বাংলায় যেসব শিল্প গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্য ও পানীয়, তামাক, পাট, টেক্সটাইল, জুতা, ফার্নিসার, প্রিন্টিং, কেমিক্যাল, পেট্রোলিয়াম, ইলেক্ট্রিক্যাল ইত্যাদি। প্রায় ১৫৮০টি শিল্প খাতে ১৯৭০ সালের মধ্যে ২,০৬,০৫৮ শ্রমিক উৎপাদনে নিয়োজিত হয়। পকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে যে শ্রমিক শ্রেণী বিকশিত হচ্ছিল অচিরেই তার ইউনিয়নভূক্ত হয়ে ধর্মঘট-আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকে। কিন্তু পথটি ততো মসৃণ ছিল না। ১৯৫০ থেকে যে সকল শিল্প যাত্রা শুরু করেছিল পাকিস্তান সরকার সেগুলো রক্ষার জন্য শিল্প শ্রমিকদের ইউনিয়ন করা থেকে বিরত রাখতে নানা নীতি গ্রহণ করে। সরকার নানাভাবে শ্রমিক হয়রানি করে মালিক পক্ষকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে। অন্যদিকে মালিক বা সরকার সমর্থক দালাল নেতৃত্ব তৈরি করে শ্রমিক বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টাও ছিল সরকারের অন্যতম কৌশল। ’৫৯-র ২৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার ১১ দফা নীতিমালা ঘোষণা করলেও সামরিক শাসনের কারণে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থেকে শ্রমিকরা বঞ্চিত’ই থেকে যান। একই বছর শ্রমবিরোধ নিষ্পত্তি আইনও বাস্তবায়নের সুযোগ ছিল না। শ্রমিকরা আইন-আদালতেও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাধার সম্মুখীন হতেন। পাকিস্তান আমলের শ্রম নীতিমালাসমূহ পর্যালোচনায় বলা যায়, শ্রমিকদের ইউনিয়নের নিবন্ধন সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং শ্রমিকদের সমস্যা সম্বলিত আবেদনগুলো কোর্টে নিষ্পত্তি হতে দিনের পর দিন চলে যেত। পাকিস্তানে প্রায় ২৩ বছরের সামরিক, আধা-সামরিক শাসনে ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক আন্দোলন নানাভাবে বিকশিত হয়েছিল। ’৪৭-’৫৮ পর্যন্ত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সরকারি বা সরকার সমর্থক থাকলেও দেশে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী আন্দোলনের প্রভাবে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বিকশিত হয় এবং তাতে শ্রমিক আন্দোলনেও পরিবর্তন আসে। ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের সাথে শ্রমিক আন্দোলনও জনসমর্থন লাভ করে। এর মধ্যেই বামপন্থীরা নিজস্ব ইউনিয়ন ও ফেডারেশন কেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং তা বিকশিত হয়। নিজেদের অর্থনৈতিক দাবির বাইরেও শ্রমিক সংগঠনগুলো স্বাধীনতা অভিমুখী আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসে এবং পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হয়ে পড়েন।
’৬৯-’৭০ সালকে বস্তুত শ্রমিকদের জাগরণকাল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। শ্রমিক সংগঠনগুলোর ঘেরাও আন্দোলন ও শ্রমিক সভাগুলোতে শ্রমিক অধিকারের দাবির সাথে স্লোগান ওঠে “শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরÑপূর্ব বাংলা স্বাধীন কর”। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিকরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধও করেন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র অর্জনে তাই এ দেশের শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ও অবদান স্বর্ণাক্ষরে স্মরণ হবে।
স্বাধীনতার পর শিল্প পরিস্থিতি এবং শ্রমিক আন্দোলন ভিন্নরূপ লাভ করে। অ-বাঙালিদের ফেলে যাওয়া শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার অধিগ্রহণ করে নানা কর্পোরেশনে ভাগ করে দেয়। বৃহৎ শিল্প এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করা হয়। এই সময় শ্রমিক সংগঠনগুলো ব্যবস্থাপনায় কাছাকাছি চলে আসে এবং একটি নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। সরকার ’৬৯-এর শিল্প সম্প্রীতি অর্ডিন্যান্স গ্রহণ করে। মে দিবসকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করে। সরকারি খাতে শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধাদি প্রদানে মজুরি কমিশন গঠন করে। রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পের ইউনিয়নগুলোতে সরকারি প্রভাব বৃদ্ধি বা ইউনিয়নগুলো সরকারি দলে অন্তর্ভূক্তি হওয়ার আগ্রহ বাড়ে এবং ইউনিয়নগুলোকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে আনার পদক্ষেপ শুরু হয়। এতে করে স্বাধীনতাপূর্বকালের বামপন্থীদের তত্ত্বাবধানে গঠিত বা তাদের প্রভাবাধীন ইউনিয়নগুলোর সাথে সরকারি দলের ইউনিয়নগুলোর একটা সাংঘাতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান আমলে ব্যক্তি মালিকের পক্ষে রাষ্ট্র বা সরকার কাজ করতো, কিন্তু স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র ও সরকার শ্রমিকদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। নতুন মাত্রা পেল শিল্পবিরোধ। ফলে একদিকে সরকার সমর্থক নিয়ন্ত্রিত ইউনিয়ন যারা ব্যবস্থাপনার কাজ থেকে নানা আর্থিক সুবিধা প্রাপ্ত হলো। অন্যদিকে বামপন্থী ইউনিয়নগুলো নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলে শ্রমিক আন্দোলন অব্যাহত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করল। কিন্তু সরকারি সুবিধা গ্রহণ করে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই ইউনিয়নগুলো সুবিধাবাদী বা সংস্কারবাদী হয়ে শ্রমিকদের মূল দাবি আদায়ে অনীহা প্রকাশ করল। তারা সংগ্রামশীল ইউনিয়নকে দমন-নিপিড়ন করার হাতিয়ারে পরিণত হলো। এর পরেও শ্রমিক আন্দোলনের একটা পরিবেশ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সামরিক শাসন জারি হলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকূলে চলে যায়। সামরিক শাসনামলে ইউনিয়নগুলো হাইজ্যাক হয়ে যায় এবং শ্রমিক নেতাদের ওপর চরম জেল, জুলুম ও নির্যাতন নেমে আসে। কোনো কোনো সেক্টরে কিছু কার্যকর আন্দোলন হলেও সুবিধাবাদের ধারা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে।
আশির দশকে প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কলকারখানা বিক্রি, কাঠামোগত সংস্কারের নামে শ্রমিক ছাঁটাই, গোল্ডেন হ্যান্ডশেক, ব্যক্তিখাতের প্রসার, বিরাষ্ট্রিকরণ, ভর্তুকি প্রত্যাহার, প্রকৃত মজুরি কমানো এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার নামে বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলে বাংলাদেশের শিল্পনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এর আশু প্রভাব হিসেবে দেখা গেল বৃহৎ রাষ্ট্রীয় খাতের দক্ষ শ্রমিকদের অবসরে পাঠানো, ছাঁটাই এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। পাট ও টেক্সটাইল খাতের শ্রমিকদের নেতৃত্বে বিরাষ্ট্রীকরণ বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তারই ধারাবাহিকতায় ’৮০-তে গড়ে ওঠে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বা স্কপ। ’৮৪-তে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার জন্য স্কপের সঙ্গে সরকারের একটি চুক্তি হয়। কিন্তু ’৯০-র পর শ্রমিক আন্দোলনের শক্তি ক্রমাগত নিম্নমুখী হতে থাকে। এখন পাল্টে গেছে শিল্প পরিস্থিতিও। রাষ্ট্রীয় খাত এখন ক্ষিয়মান; ফুলেফেঁপে উঠছে ব্যক্তিখাত। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ হয়ে উঠছে শিল্পপ্রধান। বাংলাদেশের শিল্পের প্রধান অভিমুখ পোষাক শিল্প। ইপিজেডে পোষাক শিল্প ট্রেড ইউনিয়ন আইনের বাইরে এখানে চল্লিশ লক্ষাধিক শ্রমিকের মধ্যে ত্রিশ লক্ষাধিক নারী। এছাড়া জাহাজভাঙ্গা শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ইমারত, টেক্সটাইল সহ অন্যান্য খাতে শ্রমিকদের ঘননিয়োগ। এখানে পুঁজিঘন শিল্প বিকশিত হচ্ছে কিন্তু তার সংখ্যা কম। গড়ে উঠেছে ‘ইনফরমাল সেক্টর’ ও সেবা খাত। এখানেও বিপুল শ্রমিক নিয়োজিত। এছাড়া ট্রান্সপোর্ট শ্রমিক ইউনিয়নগুলো সরকারি অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়েছে বলা চলে। শিল্প বিকাশের এই নতুন পরিস্থিতিতে প্রায় সকল শ্রমিক’ই ইউনিয়নের বাইরে পড়ে আছেন। অনেক শ্রমিক সংগঠন ইউনিয়ন নির্ভর না হয়ে প্রজেক্ট নির্ভর হয়ে পড়েছে। তাই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির সময়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে শ্রমিকরা এখন: সর্বনিম্ন মজুরি ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার বঞ্চিত, নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা নেই, নেই শিল্পের সুরক্ষা। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সেবা নেই, উন্নত হচ্ছে না কর্ম পরিবেশ। এছাড়া রেজিষ্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়ন সরকারের নিয়ন্ত্রণে, রাষ্ট্রীয় খাত সংকুচিত হওয়ায় অভিজ্ঞ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা-কর্মীর ঘাটতি, শ্রমিক অধিকার বান্ধব নীতিমালা নেই, গু-া মাস্তান যেমন আছে তেমনি শিল্প পুলিশও শ্রমিক বান্ধব নয়।
বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন এখন আর দেশীয় গণ্ডির মধ্যে নেই, সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পুঁজিপাতি ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। গার্মেন্টেসে আগুন, ভবন ধসসহ নানা বিপর্যয়ের কারণে এই শিল্প পরিস্থিতি এখন উভয়মুখী সংকটে রয়েছে। আন্তর্জাতিক পুঁজিপাতি বা বিনিয়োগকারীগণ চায় তাদের এদেশীয় কারখানায় কোনো শ্রমিক বিরোধ থাকবে না, দেশীয় পুঁজিপাতিগণ চায় এখানে কোনো শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন থাকবে না। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা চাইছেন শ্রমিকদের সুরক্ষা না থাকলে তারা পণ্য কিনবেন না। শ্রমিক পরিস্থিতি নির্দিষ্ট মান অর্জন না করলে জিএসজি সুবিধা বাতিল হবে; মালিকপক্ষ চায় শ্রমিকের অধিকার সরকারি কোষাগার থেকে দিতে হবে, তাদের মুনাফা থেকে নয়। রাজনৈতিক দলগুলো চায় শ্রমিক সংগঠন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, আবার অনেকেই চায় শ্রমিক আন্দোলন শুধু প্রশিক্ষণ নির্ভর থাকবে। শ্রমিক আন্দোলন সুবিধাবাদ, সংস্কারবাদ, লেজুড়বৃত্তি বিকশিত হলেও শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, নূন্যতম মজুরি, জে-ার সাম্য, স্বাস্থ্য ও দরিদ্র বিমোচন শুধু নয়, সার্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি এখনো অধরা।
নয়া উদারতাবাদীর নীতিমালায় ব্যক্তি পুঁজির বিকাশ অবাধ করার নামে যে সকল সুরক্ষামূলক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হচ্ছে তাতে শ্রমিকদের শ্রম শোষণ-লুণ্ঠন, অবাধ ও নৃশংস করা হয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনের বিভক্তি এবং নানা নিপীড়নমূলক নীতিমালার কারণে শ্রমিকদের বৃহদাংশ ট্রেড ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত নন। এতে করে শ্রমিকদের চেতনাগত বিকাশ যেমন হচ্ছে না, তেমনি অধিকার আদায়ে তাদের বিচ্ছিন্ন কিছু আন্দোলন অনুরোধ ছাড়া সংগঠিত কোনো আন্দোলন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে আজ প্রয়োজন শ্রমিকদের মধ্যে সংহতি এবং ঐক্য। এবারের মহান মে দিবসে সেটাই হোক শ্রমিকশ্রেণির অঙ্গীকার।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

সর্বশেষ