বৃহস্পতিবার,২৫,এপ্রিল,২০২৪
38 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে তার অভাব বিশেষভাবে অনুভূত হবে

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে তার অভাব বিশেষভাবে অনুভূত হবে

।। রাশেদ খান মেনন ।। 

সকালে আমার সহকর্মী মানোয়ার জানালো মকসুদ ভাই, সৈয়দ আবুল মকসুদ আমার প্রকাশিতব্য বইয়ের ভূমিকাটা এখনো লিখে উঠতে পারে নি। আমি যেন তাকে একটু তাগাদা দেই, কথা বলি। সেই চিন্তা থেকে রাত আটটা-সাড়ে আটটার দিকে তাকে ফোন দিবো, ফোন বের করেছি এমন সময় মানোয়ারের আবার ফোন, আমি মকসুদ ভাইয়ের কোনো খবর জানি কি না। সে ডেইলী স্টারের লিংকে একটা খবর দেখেছে মকসুদ ভাই নেই বলে। তাড়াতাড়ি মোবাইলে ফেসবুক দেখা শুরু করলাম। কারণ জানতাম সে ধরনের কোনো দুর্ঘটনা হলে ফেসবুক থেকে তার খবর পাওয়া যাবে। এবং পাওয়া গেল। প্রথম আলো’র সরফুদ্দিন পিন্টু (বর্তমানে সাবেক) তার পাতায় এই সংবাদ নিয়ে মকসুদ ভাই সম্পর্কে ইতোমধ্যে লিখেছেন। লিখেছেন আরও অনেকে। কিন্তু আমার লেখার হাত উঠছিল না। কারণ আমার বইয়ের ভূমিকা কেবল নয়, আরও বেশকিছু বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা হয়েছিল। অবশ্য করোনার কারণে মুখোমুখি দেখা হয় নি, এমনকি জুমের মাধ্যমেও নয়। অথচ এর আগে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে দেখা হতো। আমাদের পার্টি অফিসেও মাঝে মাঝে আসতেন। তবে লেখালেখি ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে এতো ব্যস্ত থাকতেন যে, সেটাও বেশি হয়ে উঠত না। তবে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে ফোনে যোগাযোগ হতো।
সম্প্রতি তিনি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বই মেলাকে সামনে রেখে প্রকাশনা সংস্থার ‘প্রথমা’র জন্য মওলানা ভাসানীর ওপর একটা বইয়ের প্রুফ দেখা নিয়ে। এছাড়া ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে এলামনাই এসোসিয়েশনের স্মারক গ্রন্থের পুরো দায়িত্ব ছিল তাঁর। আমার কাছ থেকে একটা লেখাও নিয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি যে বিষয় নিয়ে আমার সাথে তার বিশেষ কথা হয়েছিল তা’হলো মওলানা ভাসানী সম্পর্কে রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী, লেখক-গবেষক ও ইতিহাসবিদদের মধ্যে যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে তা অপনোদনের জন্য যৌথভাবে ‘মওলানা ভাসানীর সত্য-অসত্য’ নামে একটা বই লেখার। কেবল তাই নয়, ওয়ার্কার্স পার্টির স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর কর্মসূচিতে মওলানা ভাসানীর মৃত্যু দিবসে তাঁর প্রধান আলোচক থাকার কথা হয়েছিল। সেভাবে হলও ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে তার সাথে মিলে সেই বই লেখা যেমন হবে না, তেমনি আমাদের সবার ও জাতির দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার সঞ্চালনায় ভাসানীর অনন্য ও অগ্রগামী ভূমিকা সম্পর্কে তার গবেষণালব্ধ তথ্যাবলি জানা যাবে না। তবে আশার কথা ‘প্রথমা’ যদি তার বইটা প্রকাশ করে তবে অনেক অজানা বিষয় আমরা জানতে পারবো এবং মওলানা সম্পর্কে যাদের কথা ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি তাদের নাঁক উচু মনোভাব, তাঁর অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা কিছুটা হলেও দূর হবে।
কেবল মওলানা ভাসানী সম্পর্কে নয়, মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কেও বহু অজানা কথা আমরা মকসুদ ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পেরেছি এবং এজন্য তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। যেনেছি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সম্পর্কে। জেনেছি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, বুদ্ধদেব বসু’র সম্পর্কেও। আরও অসংখ্য বিষয় সম্পর্কে জেনেছি যা ছড়িয়ে আছে তার ৪০টির বেশি বই ও অসংখ্য কলামে।
তবে মকসুদ ভাইয়ের লেখক-গবেষক-সাংবাদিক সত্ত্বার বাইরে আর একটি সত্ত্বা সবার কাছে পরিচিত তা হলো বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সেটা সড়ক দুর্ঘটনা, নদী দূষণ, পরিবেশ রক্ষা, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা, যাই হোক না কেন। এসব অসংখ্য বিষয়ে তার প্রতিবাদী অবস্থান। তার কলাম লেখার ব্যাপারে আপত্তি করায় তিনি প্রতিবাদে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার উপ-বার্তা সম্পাদকের লোভনীয় চাকুরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তেমনি ইরাকে সা¤্রাজ্যবাদী হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি পশ্চিমা পোশাক ছেড়ে দিয়ে সাদা কাপড়ের বেশ নিয়েছিলেন। অনেকে এটা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি যে তার প্রতিবাদে আমৃত্যু অটল ছিলেন তার প্রমাণ তাঁর শেষ সময় পর্যন্ত পরিহিত পোশাক। সেই সাদা কাপড় পরিধান করে তিনি অন্তিম শয়ানে গেলেন। কিন্তু তার ঐ পোশাকের ঔজ্জ্বল্যই তাকে সবার থেকে পৃথক করে মানুষের কাছে বাঁচিয়ে রাখবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ একজন পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। যে কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনায় তার প্রতিবাদী চেহারা দেখেছি। তার লেখায়, চলায়-বলায় এটা স্পষ্ট ছিল। ফেসবুকে একটা পোস্টে তাকে প্রশংসাবাক্যে ভাসিয়ে দেয়ার পরও তাকে ‘বামাতি’ বলে উল্লেখ করে তার ঐ অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এটা কেন জানি না। তবে মকসুদ ভাই কেবল একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিই ছিলেন না, তিনি তার সময় একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে এই যে বাংলাদেশ আমরা দেখতে চাই তার অনুপস্থিতিতে সেই মহতি ভাবনা আমরা অনুভব করব।
২৪.০২.২০২১

সর্বশেষ