মঙ্গলবার,১৯,মার্চ,২০২৪
28 C
Dhaka
মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪
Homeশিক্ষা সংস্কৃতিশিক্ষাআসছে নতুন শিক্ষাক্রম

আসছে নতুন শিক্ষাক্রম

ক্যারিকুলামের সাথে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার

নতুন কথা পরিবর্তন ॥ শিক্ষায় আসছে বড় পরিবর্তন। বদলে যাচ্ছে শিক্ষাক্রম। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাই থাকছে না। আর ১০ম শ্রেণীর আগে শিক্ষার্থীদের বসতে হবে না কোনো পাবলিক পরীক্ষায়। উঠে যাচ্ছে জেএসসি, জেডিসি ও পিইসি পরীক্ষা। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি-পড়তে হবে অভিন্ন ১০ বিষয়ে। শিক্ষার্থীরা মানবিক, বিজ্ঞান নাকি বাণিজ্য বিভাগে পড়বেন তা সিন্ধান্ত নিতে হবে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে একাদশে-এমনটাই জানানো হয়েছে নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩ সেপ্টেম্বর এর অনুমোদন দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি সাংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শিক্ষাক্রমের বিস্তারিত দিক তুলে ধরেছেন। তবে শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষকরা নতুন এই শিক্ষাক্রমকে স্বাগত জানালেও তা বাস্তবায়নে সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, “শুধু কারিকুলাম পরিবর্তন করলেই হবে না। এর সফল বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধিতে নজর না দিলে ক্যারিকুলাম পরিবর্তন করলে নতুন শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। চুড়ান্ত রূপরেখা দেখে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও বিশ্বপরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে শিক্ষাব্যবস্থা আরো আধুনিকায়ন করতে হবে। শিক্ষা কার্যক্রম যুগোপযোগী করা একান্তভাবে অপরিহার্য। আবার অনেকেই বলছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে হাতে সময় খুবই কম। এত অল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান করে সামনে এগিয়ে যাওয়া বিরাট চ্যালেঞ্জ।
নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় অনুযায়ী আগামী বছর থেকে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণী এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পাইলটিং শুরু হবে। ২০২৩ সাল থেকে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে শুরু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণী এবং ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণীতে এই শিক্ষাক্রম শুরু হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে পুরো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।
রূপরেখায় বলা হয়েছে, সব ধরনের শিখন মূল্যায়নের ভিত্তি হচ্ছে যোগ্যতা। অর্থাৎ শিক্ষার্থী শিখেছে কিনা সেটা সামনে রেখে মূল্যায়ন করা হবে। পরীক্ষার চেয়ে শ্রেণি মূল্যায়নে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেওয়া হবে না। শিক্ষকের মূল্যায়নের মাধ্যমে পরের শ্রেণিতে পদোন্নতি দেওয়া হবে শিক্ষার্থীদের। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৬০ শতাংশই শিক্ষক সারাবছর ধরে মূল্যায়ন করে নম্বর দেবেন। বাকি ৪০ শতাংশ নম্বরের ওপর ৫ বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান) পরীক্ষা হবে। যেটিকে বলা হচ্ছে সামষ্টিক মূল্যায়ন। ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণীতেও বিদ্যালয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ হবে মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার মাধ্যমে। নবম ও দশম শ্রেণীতে কয়েকটি বিষয়ে শিখনকালে অর্ধেক মূল্যায়ন হবে এবং বাকি অর্ধেক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ৩০ ভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৭০ ভাগ মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার মাধ্যমে। এইচএসসি পরীক্ষা হবে দুবার। প্রথমবার একাদশ শ্রেণিতে, শেষবার দ্বাদশ শ্রেণিতে। দুটি পরীক্ষাই বোর্ডের অধীনে হবে। দুই পরীক্ষার নম্বর যোগ করে হবে চূড়ান্ত ফল। বর্তমান সময়ের তুলনায় অর্ধেক নম্বরে এসএসসি পরীক্ষা হবে। প্রতি বিষয়ে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা স্কুলেই হবে। বাকি ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেবে শিক্ষা বোর্ড। এসএসসি ও এইচএসসি উভয় স্তরের পরীক্ষাতেই বিষয় সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে অর্ধেক কম হবে।
নতুন এই শিক্ষক্রমের রূপরেখার লক্ষ্য হলো-মৌলিক ও ডিজিটাল সাক্ষরতা, সৃজনশীল ও সুক্ষ্মচিন্তা, সমস্যা সমাধান, স্ব-ব্যবস্থাপনাসহ ১১টি দক্ষতা অর্জন। পাঁচ ধরনের জ্ঞান শিক্ষার্থীকে দেওয়া হবে। সেগুলো হচ্ছে-পাঠ্যবই, আন্তঃবিষয়, বিষয়ভিত্তিক বিশেষ জ্ঞান ও পদ্ধতিগত জ্ঞান। উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশপ্রেম, সম্প্রীতিসহ ৬ ধরনের মূল্যবোধ জাগ্রত এবং আত্মবিশ্বাসসহ তিন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি। সবমিলে দশটি যোগ্যতা অর্জন করবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত যে ১০ ধরনের শিখনক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে তা হলো-ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
নতুন শিক্ষাক্রমের বৈশিষ্ট্য শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, আনন্দময় পড়াশোনা হবে। বিষয়বস্তু ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমানো হবে। গভীর শিখনে গুরুত্ব দেওয়া হবে। মুখস্থ-নির্ভরতার বিষয়টি যেন না থাকে, এর বদলে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শেখাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা ও অন্যান্য কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেছেন, এই রূপরেখা শিখন কার্যক্রম ক্লাসরুমের নির্দিষ্ট ছকের সঙ্গে বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণের কথা বলেছে। এতে শেখা বা জ্ঞানার্জন আরো আনন্দদায়ক হবে।
কিন্তু শিক্ষাবিদরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষকদের প্রস্তুত করতে হবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যুগোপযোগী করে প্রস্তুত করতে হবে। শুধু ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে হবে না। মফস্বল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোর দিকেও তাকাতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমের অনেক ভালো দিক আছে। এখন পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন না করলে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে না। কারণ, এর আগে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হলেও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত দক্ষ করতে না পারায় সেটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায় নি। তাই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলতে হবে। একই সঙ্গে সারা দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মূল ভূমিকায় থাকবেন শিক্ষকেরা। অথচ এখন পর্যন্ত দেশে শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। আবার শিক্ষকদের একটি বড় অংশের দক্ষতারও ঘাটতি রয়েছে। তাই যোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি দক্ষতা বৃদ্ধির ওপরও জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
শিক্ষাবিদরা শিক্ষায় বিনিয়োগ আরো বাড়ানোর কথা বলছেন। আর এই বিনিয়োগ ব্যবহারে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। জানা গেছে, ইউনেস্কো দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে আসছে। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও শিক্ষায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১১.৯২ শতাংশ।
তিন বছর আগে প্রকাশিত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের সর্বশেষ একাডেমিক সুপারভিশন রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪০.৮১ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারেন না। অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন ২৫.৯৯ শতাংশ শিক্ষক। আর বাইরে থেকে প্রশ্ন প্রণয়ন করেন ১৪.৮৩ শতাংশ শিক্ষক।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যে শিক্ষক নিজে প্রশ্নই করতে পারেন না, তিনি কিভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন। অথচ নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের হাতেই বেশির ভাগ নম্বর রাখা হয়েছে। তাই কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই শিক্ষকদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষকরা শুধু ক্লাসে পড়িয়ে গেলেই হবে না, ওই শিক্ষার্থী বিষয়টি বুঝল কি না তা-ও শিক্ষককেই নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি মনোযোগ দিতে হবে মানসম্মত শিক্ষায়। তাই কেবল ক্যারিকুলামের পরিবর্তন নয়, সামগ্রীক শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে।

সর্বশেষ