মঙ্গলবার,১৯,মার্চ,২০২৪
32 C
Dhaka
মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪
Homeশিক্ষা সংস্কৃতিইতিহাসটর্চার সেল থেকে ফের যুদ্ধে

টর্চার সেল থেকে ফের যুদ্ধে

।। সৈয়দ আবুল বারক আলভী ।।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কথা বলার আগে একটু ঘুরে আসি ‘৬৩ পরবর্তী ও ‘৭১ পূর্ববর্তী সময়ে। আসলে ১৯৬৩ সালে ভর্তি হই আর্ট কলেজে। চারুকলা তখন আর্ট কলেজ নামে পরিচিত। আর্ট কলেজে ভর্তির পর থেকে আমার সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। আর সেই ছোটবেলা থেকে জড়িত ছিলাম কচিকাঁচার সঙ্গে। এই কচিকাঁচা থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সেই শেখাটা কাজে লেগেছে পরবর্তী জীবনে। এখনও লাগছে। তো ‘৬৫ বা ‘৬৬ সাল থেকে ঢাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। আন্দোলনে মুখর ঢাকা। আর্ট কলেজে পড়ার কল্যাণে এসব আন্দোলনেও সম্পৃক্ততা বাড়ে। এই সম্পৃক্ততা বাড়ার আরেকটি কারণও আছে। তা হচ্ছে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন এবং আলপনা। যে কোনো আন্দোলনে এসবের দরকার পড়ত। আর তখন তো এত আধুনিক যন্ত্রপাতি বা প্রেস ছিল না। এত টাকা কই আন্দোলনকারীদের! তাই সবাই আসতো আর্ট কলেজে। আমরা মনের আনন্দে পোস্টার লিখতাম। হলে কাগজ আসতো ভ্যান বোঝাই করে। রিমে রিমে। রঙ আসতো। রাত জেগে ব্যানার-ফেস্টুন লিখতাম। সেই পোস্টার-ব্যানারে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতো শহর।

‘৫২ সালের পর ‘৬৭ বা ‘৬৮ সাল পর্যন্ত শহীদ মিনারে আলপনা আঁকা হতো না। ‘৬৯ সালের দিকে প্রথম শুরু হয় এই আলপনা আঁকা। তখন শহীদ মিনারে যে আলপনা আঁকা হতো, তাতেও থাকতো প্রতিবাদ। আমরা শহীদ মিনার থেকে আজিমপুর পর্যন্ত আলপনা আঁকতাম। তখন প্রভাতফেরি প্রভাতেই হতো। রাত ১২টায় হতো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ যত দেয়াল, তখন এত দেয়ালও ছিল না। যে কোনো সময় যে কোনো দিকে যাওয়া যেত। এর মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত ব্যান্ড করে দেওয়া হলো। ঝড় উঠল প্রতিবাদের। সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের সঙ্গে আমরাও প্রতিবাদী আলপনা আঁকা শুরু করি। ‘৬৯-এ লাল সূর্য উদিত হলো। এটাও ছিল প্রতিবাদ। ‘৭১ সালে শহীদ মিনারের সামনে একটা প্রতিবাদ চিত্রের প্রদর্শনী করা হয়েছিল। সিম্বলিক প্রতিবাদ। দুর্গার দশ হাতকে কাজে লাগানো হয়েছিল প্রতিবাদে।

যাক, মার্চের ১৪ বা ১৬ তারিখের দিকে একটা প্রতিবাদ মিছিল বেরোয়। সেই প্রতিবাদে আমরা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করি। আগে আমরা স্বাধীকারের আন্দোলন করেছি। পরে আস্তে আস্তে এই স্বাধিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। বিশেষ করে ৭ মার্চের পর আমাদের মিছিলের ব্যানারে বড় করে লেখা ছিল স্বা-ধী-ন-তা। এই স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর বুঝলাম, কিছু একটা হতে চলছে। সবার মনে জানা হয়ে গেছে। কেমন একটা ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটছে মানুষের। এর মধ্যে এলো ২৫ মার্চ। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও গেলাম আর্ট কলেজে। বাসায় থাকতে পারছিলাম না। আসলে তখন বাসায় থাকার মতো পরিস্থিতি ছিল না। দেশের এই পরিস্থিতিতে কেউ ভালো থাকতে পারে?

সবাই এটা বুঝতাম, যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। আমার বাসা ছিল আজীমপুরে। আজিমপুর থেকে আর্ট কলেজ হয়ে গেলাম সেগুনবাগিচা। কী কাজে গিয়েছিলাম মনে নেই। সেগুনবাগিচা থেকে ফেরার পথে দেখি, সব কেমন থমথমে হয়ে পড়েছে। একটা শূন্যতা বিরাজ করছে চেনা শহরটায়। তখন আঁচ করতে পারলাম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। সেগুনবাগিচা থেকে রিকশা নিয়েছি আজিমপুরের। অচেনা শহর দেখতে দেখতে ঢাকা মেডিকেলের গেট পেরিয়ে শহীদ মিনারের সামনে এসে বুঝলাম, কিছু একটা হয়েছে। সবাই বলাবলি করছে, সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরের দিকে আসছে। এবার কিছু একটা ঘটবেই!

রিকশা ছেড়ে আজিমপুরের দিকে হাঁটা ধরলাম। ইডেন কলেজের মোড়ে এসে দেখি টায়ার, পাইপ, বাঁশ নিয়ে মানুষ রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে। নির্মলেন্দু গুণকেও দেখলাম সেখানে। আমিও দাঁড়ালাম। যোগ দিলাম তাদের সঙ্গে। হঠাৎ দেখি, সাংবাদিক নূরে আলম সাইকেল নিয়ে এগিয়ে আসছেন। চিনতাম ওনাকে। তিনিও চিনতেন। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। কই যাচ্ছেন? তিনি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে সেনাবাহিনীর কনভয় আসছে আমি সেটা কাভার করতে যাচ্ছি।’

এই বলেই সাইকেলের প্যাডেল চেপে চলে গেলেন। একটু পর দেখলাম, নিউমার্কেটের দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। চারদিক আরও থমথমে হয়ে যায়। এতক্ষণ দু-একটা গাড়ির শব্দ পেলেও এখন গাড়ির শব্দও নেই। এই শব্দহীন শহরে গোলাগুলির শব্দ আরও তীব্র হয়। তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে। এই শব্দে রাস্তা থেকে মানুষও কমতে থাকে। মুহূর্তেই রাস্তা খালি হয়ে যায়। ভাবলাম, বাসার দিকে যাই। এগোতেই দেখি, পিলখানার দিকে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।

আমিও বাসায় গেলাম। শব্দ কিন্তু বেড়েই চলছে। যে বাড়িতে থাকতাম আমি সেটি একতলা বাড়ি। সামনের বাড়ি চারতলা। সেই বাড়ির ছাদে গিয়ে উঠলাম পরিস্থিতি দেখার জন্য। দেখি, ইকবাল হলের দিকে কিছু বস্তি ছিল সেসব জ্বলছে। আগুন বাড়ছে শহরে। বাসা থেকে ডাক পড়েছে আমার। নেমে বাসায় গেলাম। আগুন জ্বলছে শহরে। ভাবতে থাকলাম কী করা যায়! এই ভাবনায় রাত কাটল। পরদিন কারফিউ। ২৬ মার্চ দুপুর পর্যন্ত থেমে থেমে গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসছিল।

২৭ মার্চের দিকে কারফিউ শিথিল করা হলো। ভাবলাম, আর বসে থাকা যায় না। বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় বের হতেই দেখি বিধ্বস্ত ঢাকা। এমন ঢাকা কখনও কল্পনা করিনি। তো বের হয়ে ভাবলাম, আগে একটু আর্ট কলেজের হোস্টেলে যাই। জানতাম, ছাত্রদের অনেকেই বাড়ি চলে গেছে বা যে যেখানে পেরেছে আশ্রয় নিয়েছে। আর এও জানতাম যে, আন্দোলনের সব ব্যানার-ফেস্টুন হোস্টেলেই রয়েছে। তাই গেলাম হোস্টেলের দিকে। গিয়ে শুনলাম শাহনেওয়াজ ও নজরুলকে গুলি করা হয়েছে। শাহনেওয়াজ বেঁচে নেই আর। তার নামেই পরে আর্ট কলেজের হোস্টেলের নামকরণ হয় ‘শাহনেওয়াজ হল’। আর নজরুল তখনও বেঁচে ছিল। তাকে শত্রুদের গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলো। বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেল গুলি। সে তখন হসপিটালে। হসপিটালে গেলাম তাকে দেখতে। তারপর গেলাম সুফিয়া কামালের কাছে। ওই সময়টুকু কাছের মানুষদের খোঁজ-খবর নিয়েই কাটিয়েছি। এরপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ফের কারফিউ জারি হয়ে গেল। তবে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যেতে পারিনি। আগের রাতেই খবর পেয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এসব খবরে একসময় ঠিক করলাম যুদ্ধে যাব। তখন অবশ্য সরকারি চাকরি করতাম। ফিল্ম অ্যান্ড পাবলিকেশন্সে। অফিসও কামাই করতে থাকি। এর মধ্যে খবর পেলাম আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প হচ্ছে। কুমিল্লার চান্দিনা হয়ে গেলাম ওপারে। গিয়ে দেখি তখনও ক্যাম্প হয়নি। এপ্রিলের শেষের দিকের কথা। শরণার্থীরা ভিড় করছে। তাদের জন্য ক্যাম্প করা হলো। আমাকে থাকতে দেওয়া হলো একটা কলেজে। তখন সিগারেট খেতাম। কিন্তু টাকা নেই। চা-ও খেতে পারছিলাম না। একদিন ফজলুল হক মনি ভাই আমাকে দেখে বললেন, ‘গাড়িতে ওঠো। চলো আমার সঙ্গে।’ বললাম, আমার সঙ্গে আমার বন্ধু আহরার আছে। কী করে যাবো? তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানিও।’ কচিকাঁচার মেলাতেই মনি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। শরণার্থীদের খাবারের কষ্ট, থাকার কষ্ট, টয়লেট-গোসলের কষ্ট দেখি। নিজের কাছেও নেই টাকা। এর মধ্যে আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, ‘তুমি একটা কাজ করে দিতে পারলে একটু সিগারেট আর চা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’

তারপর তিনি কলকাতায় তার শ্যালকের একটি ঠিকানা দিয়ে বললেন, ‘আমি ড্রাইভার ঠিক করে রেখেছি। তুমি তোমার বন্ধুকে নিয়ে এই ঠিকানায় গাড়িটা পৌঁছে দেবে। ফেরার জন্য তোমাদের বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবে সে।’

আমি তো যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। তখন ব্র্যান্ডেড গাড়ির খুব কদর। গাড়িটা ছিল সম্ভবত ফক্সওয়াগন বা মরিচমাইনর। বন্ধু আহরারকে নিয়ে রওনা দিলাম কলকাতায়। দুই রাত তিন দিন পর কলকাতায় গিয়ে পৌঁছলাম। এমন কত অভিজ্ঞতা হলো! এর ভেতর দেশে এলাম। আবার গেলাম। আগস্টের শেষের দিকে প্রচুর অস্ত্র নিয়ে দেশে প্রবেশ করলাম। একেকজনের ঘাড়ে মণ খানেক ওজনের ব্যাগ। পথে কত কী দেখলাম। কত রকমের সমস্যার মুখোমুখি হলাম। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলতে দেখেছি। আমরা স্টেনগান, গ্রেনেড নিয়ে এসেছি। ঢাকায় এলাম এক গভীর রাতে। অস্ত্র কোথায় রাখা যায় তা নিয়ে পড়লাম বিপদে। শেষে বাড্ডায় বাকেরের পরিচিত এক বাড়িতে রাখতে দিলাম। বাড্ডায় তখন পানি আর পানি। মাঝে এক-দুটি ঢিবি। সেই ঢিবিতে ছোট ছোট বাড়ি। এমনই একটি বাড়িতে রাখা হয়েছে অস্ত্র। পরদিন একটি মিটিং ঠিক করলাম। দলের সদস্য চারজন। বাকের, কমল, ফতেহ আলী ও আমি। তিনজন এলাম। বাকের আসেনি। ফতেহ আলী ছিলেন দলনেতা। তিনজনের একজন না আসায় আমাদের সন্দেহ হলো, বাকের হয়তো ধরা পড়েছে। কোনোভাবেই বাকেরের আর খোঁজ পাইনি। এর মধ্যে গেলাম আলতাফ মাহমুদের বাসায়। শহীদবাগ ছিল তার বাসা। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের ঠিক উল্টো পাশে। কথা-আড্ডায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। বের হতে যাব, তখনই তার স্ত্রী বললেন, ‘বেশি বাহাদুরি করো না। একটু পর থেকে কারফিউ। আজ আর যাওয়ার দরকার নেই। থেকে যাও।’ আমিও থেকে গেলাম। আর ওই রাতেই। মানে ২৯ আগস্ট আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আমাকে ধরে নিয়ে গেল পাকিস্তানি সেনারা। পরদিন নিয়ে গেল মার্শাল ল কোর্টে। সেখানে গিয়ে দেখা রুমী, জামি ও তাদের বাবার সঙ্গে। ক্রিকেটার জুয়েলকেও দেখেছি। লাইনে বসিয়ে রেখেছিল সবাইকে। আমিও বসলাম। সেনাদের যে-ই আসে সেই এক লাথি দিয়ে যায়। এর মধ্যে একজন এসে বলে, ‘আলভী কোন হ্যায়?’ এটা শোনার পর বুকটা ধড়াক করে ওঠে। আমার মতো অখ্যাত তরুণকে তো তাদের চেনার কথা নয়। ফের চেঁচিয়ে উঠল। আমি হাত তুললাম। তারপর আমাকে টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। মারতে মারতে জানতে চায় অন্যরা কোথায়? আমি তখন বুঝে যাই নিশ্চয়ই বাকের ধরা পড়েছে। তারা আমাদের চারজনের সব বলে দিলো। কবে, কেমন করে অস্ত্র নিয়ে দেশে এলাম সব। আমি অস্বীকার করলাম। একটু পর বাকেরকে আমার সামনে আনা হলো। তাকে চেনা যাচ্ছে না। কথা বলার শক্তি নেই তার। আমাকে দেখিয়ে বলা হলো, ‘ইয়ে আলভী হ্যায়?’ সে মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। তারপর বেড়ে গেল অত্যাচার। পরদিন ফের কোর্টে তোলা হলো। ঢোকার পথে একটা খাতা ছিল। তাতে সবাই নাম এন্ট্রি করে ঢুকছে। আমি নাম লিখলাম সৈয়দ আবুল বারক। আলভীটা বাদ দিয়ে দিলাম। সেদিনের অফিসারাও ছিল নতুন। পরে তারা নানান জেরার পর একসময় কোরআন শপথ করিয়ে আমাকে মুক্তি দিয়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে মাসখানেক বাসায় থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে ফের চলে গেলাম ক্যাম্পে। আবার জড়িয়ে গেলাম যুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হলো। তবু ভুলতে পারি না ২৫ মার্চের সেই স্মৃতি। সেগুনবাগিচা থেকে আজিমপুরের পথে যা দেখেছি। ২৭ মার্চ যা দেখেছি, তা আজ ভেসে ওঠে স্মৃতির ক্যানভাসে।

লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা, চিত্রশিল্পী, অধ্যাপক, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ